ডা. মুনতাসীর মারুফ :: স্যাটেলাইট চ্যানেলের কল্যাণে বিদেশী একটি মোবাইল ফোন কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখে থাকবেন অনেকেই। ওই বিজ্ঞাপনের মূল স্লোগান ছিল ‘ওয়াক এন্ড টক’। অর্থাৎ কি না মোবাইল ফোনে কথা বলার সময়টুকুতে হাঁটুন। ফোন কোম্পানিগুলোর নানা ‘অফারে’র বদৌলতে মোবাইলে কথা বলার প্রবণতা যে ব্যাপকহারে বেড়েছে- এ কথা অনস্বীকার্য। এমনকি অনেককে বিছানায় গা এলিয়ে অথবা সোফায় পিঠ হেলিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল ফোনে কথা বলতে দেখা যায়। বিজ্ঞাপনে এই কথা বলার সময়টুকুতে বসে বা শুয়ে না থেকে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলার পরামর্শ দেয়া হয়। এবং বিজ্ঞাপনের শেষাংশে দেখানো হয়, এই অভিনব ‘আইডিয়া’ অনুসরণের ফলে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীরা শারীরিকভাবে আগের চেয়ে অনেক বেশি ‘ফিট’ হয়ে উঠেছেন।
মূলত আলোচ্য কোম্পানির প্রচারণার জন্যই বিজ্ঞাপনটির সৃষ্টি, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত বক্তব্যটিও রসিকতার ঢংয়ে উপস্থাপিত হলেও বেশ গুরুত্ব বহন করে। অনেক আগে থেকেই চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা মেনে আসছেন, হাঁটাই সর্বোৎকৃষ্ট ব্যায়াম। সব বয়সের মানুষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী এ ব্যায়ামটি সবচেয়ে কম খরচে শারীরিকভাবে সবচেয়ে ভালো থাকার অন্যতম উপায়। জন্মের এক বছরের মাঝেই শিখে নেয়া এ ব্যায়ামটি ঘরে-বাইরে যে কোনো জায়গায় করা যায়, ব্যক্তির শারীরিক ক্ষমতা অনুযায়ী এর তীব্রতা বাড়ানো-কমানো যায়, উপযুক্ত পোশাক এবং এক জোড়া ভালো জুতো ছাড়া এর জন্য আর কোনো অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রয়োজন পড়ে না।
হৃদযন্ত্রের সুরক্ষা ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ
নিয়মিত হাঁটার ফলে হৃদযন্ত্রের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে, হৃদযন্ত্র স্বল্প চেষ্টায় দেহে অধিক পরিমাণে রক্ত সরবরাহ করতে পারে এবং ধমনীর ওপরও চাপ কম পড়ে। ফলে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই হাঁটা অনেকটা উচ্চ-রক্তচাপরোধী ওষুধের মতোই কাজ করে। এ ছাড়া হাঁটার ফলে রক্তে ‘খল কোলেস্টেরল’ নামে পরিচিত লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন কমে যায়। এই ‘খল কোলেস্টেরল’ পরিমাণে বেড়ে গেলে তা ধমনীর গায়ে জমা হয়ে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৭২ হাজার নারীর ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সপ্তাহে অন্তত তিন ঘণ্টা অথবা দৈনিক আধঘণ্টা করে হাঁটেন, তাদের ক্ষেত্রে হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কম।
ডায়াবেটিস ও স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস
যুক্তরাষ্ট্রে ডায়াবেটিস প্রিভেনশন প্রোগ্রামের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সপ্তাহে ১৫০ মিনিট হাঁটা আর দৈহিক ওজন ৭% কমানোর মাধ্যমে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ৫৮% কমিয়ে আনা যায়। অন্যদিকে, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানান, দৈনিক এক ঘণ্টা করে সপ্তাহে ৫ দিন হাঁটার মাধ্যমে স্ট্রোকের ঝুঁকি ৫০% হ্রাস পায়।
হাড়ের ক্ষয় ও ভাঙন রোধ
গবেষণায় দেখা গেছে, রজঃনিবৃত্তি-পরবর্তী বয়সে যেসব মহিলা প্রতিদিন অন্তত এক মাইল করে ব্যায়ামের উদ্দেশে হাঁটেন, তাদের হাড়-ঘনত্ব কম-সচল মহিলাদের তুলনায় বেশি। হাঁটার ফলে যেমন হাড় ক্ষয়ের প্রবণতা হ্রাস পায়, তেমনি আর্থ্রাইটিসসহ হাড়ের নানা রোগ হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়। কমে যায় বয়সকালে সহজেই কোমরের হাড় ভাঙার ঝুঁকিও।
মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন
হাঁটার ফলে ভালো লাগার অনুভূতি জাগে মনে, মানসিক চাপ বোধ হয় কম। এ সময় শরীরে এন্ডোরফিন নামের রাসায়নিকের ক্রিয়া বেড়ে যায় বলে ঘুম হয় আরামদায়ক। মেডিসিননেটডটকম ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে গবেষকরা বলেছেন, প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে তিন থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটার ফলে বিষণœতার উপসর্গ ৪৭ শতাংশ হ্রাস প্রায়। অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মহিলা সপ্তাহে অন্তত দেড় ঘণ্টা হাঁটেন, তাদের বোধশক্তি সপ্তাহে ৪০ মিনিটের কম হাঁটা মহিলাদের তুলনায় বেশি।
ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস
মহিলাদের ওপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ব্যায়ামের উদ্দেশ্যে সপ্তাহে অন্তত দেড় থেকে আড়াই ঘণ্টা হাঁটেন, তাদের স্তন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি, যারা হাঁটেন না তাদের চেয়ে ১৮ শতাংশ কম। ব্রিটিশ জার্নাল অব ক্যান্সার স্টাডিতে প্রকাশিত আরেক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাঁটার ফলে খাদ্যনালীর নিম্নাংশের ক্যান্সারের ঝুঁকি ২৫ শতাংশ হ্রাস পায়।
ওজন নিয়ন্ত্রণ, শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি
স্বাস্থ্যকর, সুষম খাবার এবং নিয়মিত হাঁটাÑ দীর্ঘমেয়াদি ওজনÑ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির মূল চাবিকাঠি। হাঁটার মাধ্যমে শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এমনকি বৃদ্ধ বয়সেও সবলতা বজায় রাখার জন্য নিয়মিত হাঁটা প্রয়োজন।
তালিকা এভাবে বাড়তেই থাকবে। হাঁটার উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না। যে কোনো ধরনের হাঁটাই উপকারী। তবে প্রকৃত সুফল পাওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞরা প্রতিদিন আধঘণ্টা করে সপ্তাহে অন্তত ৫ দিন মধ্যম গতির হাঁটার উপদেশ দেন। তবে, কোনো ধরনের শারীরিক অসুস্থতা থাকলে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নিন, কতোটুকু হাঁটা আপনার জন্য উপযোগী।
লেখক : সহকারী রেজিস্ট্রার
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।